মডেলে (লাল লাইন) যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমনের একাধিক পিক (ধূসর রঙের বারগুলো) দেখাচ্ছে। সৌজন্যেঃ ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়
কেভিন স্টাসি, ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়
সংক্রামক রোগের মডেলে আচরনগত দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একটি নতুন মডেল প্রণয়ন করেছেন যেটি বিগত ১৬ মাসে কোভিড-১৯’র সংক্রমনের ক্ষেত্রে পিক এবং ভ্যালীগুলো বিশ্লেষণ করতে পারবে।
সায়েন্টিফিক রিপোর্টস নামক জার্নালে প্রকাশিত এই পন্থাটি চলমান অতিমারির ভবিষ্যৎ গতিবিধির পূর্বাভাস দিতে এবং আগামীর কোন অতিমারি সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে সহায়ক হবে।
এই গবেষণার মুখ্য গবেষক এবং ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিকাশ শ্রীভাসটাভা বলেন “আমরা জানি কিভাবে একটি সংক্রামন ছড়ায় সেটির সাথে মানুষের আচরন জড়িত থাকে। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম যে আমরা আচরনগত দিকগুলোর পরিমান নির্ণয় করতে পারি কিনা এবং সেগুলোকে মডেলে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে দেখা যে মডেলটি যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য স্থানে সংক্রমনের ঢেউগুলোকে বিশ্লেষণ করতে পারে কিনা”।
সংক্রামক ব্যাধির সংক্রামনের মডেলিং নিয়ে প্রচলিত পন্থাকে বলা হয় এসআইআর মডেল। এই পন্থায় একটি জনসংখ্যাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়ঃ সংবেদনশীল, আক্রান্ত এবং সুস্থ। মডেলটি দুটি প্যরামিটার অনুযায়ী মানুষকে এক ভাগ থেকে অন্য ভাগে সরিয়ে ফেলে। রোগের সংক্রমনের ক্ষমতার এবং মানুষ একজন আরেকজনের কতটা সংস্পর্শে আসছে এর মাধ্যমে অনুমান করা হয় মানুষ কত দ্রুততার সাথে সংবেদনশীল অবস্থা থেকে আক্রান্ত অবস্থায় চলে যায়। সুস্থতার হার অনুযায়ী মানুষকে আক্রান্ত থেকে সুস্থ দলে নিয়ে যাওয়া হয়। (এ সকল মডেলে “সুস্থ” বলতে বোঝায় “আর কোন অবস্থায় ছোঁয়াচে নয়”, এবং এর মধ্যে যারা সংক্রমনে মৃত্যুবরন করেছেন তারাও অন্তর্ভুক্ত।)
একটি আদর্শ এসআইআর মডেলে পিকসহ একটি কার্ভ দেখা যায়-সংক্রামন ব্যাধি বিশেষজ্ঞরা মানুষকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক পড়া এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে আহবানের মধ্যে দিয়ে এই পিকটি সমতল করার চেষ্টা করেছেন যার মাধ্যমে ভাইরাসের সংক্রমণও কমবে। শ্রীভাসটাভা বলেন কিন্তু বিগত ১৬ মাসে একেকটি পৃথক রাষ্ট্রে, সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে এবং অন্যান্য দেশে সংক্রমনের হার একটি কার্ভও দেখাতে পারেনি। বরং এ সময় সংক্রমনের একাধিক ঢেউ সংক্রামন ব্যাধি মডেলিং সমাজকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে।
অতিমারির সময়কালে শ্রীভাসটাভা একটি শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করতেন যেখানে ব্রাউন’স স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এ সংক্রামণ ব্যাধির উপর একটি মডেল অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি এবং তার ছাত্ররা মডেলের পূর্বাভাস এবং সংক্রমনের হারের মধ্যেকার গড়মিল দেখে অবাক হয়েছিলেন।
শ্রীভাসটাভা বলেন “আমরা দেখেছি একাধিক পিকের মাধ্যমে সংক্রমনের সংখ্যা বাড়ছিল এবং কমছিল কিন্তু মডেল এগুলো ধরতে পারছিল না। এর ফলে আমরা চলমান ঘটনাকে ব্যখ্যা করতে এবং পূর্বাভাস দিতে জনগণের আচরন এবং সাড়া সম্পর্কে ভাবতে শুরু করি”।
নতুন মডেল প্রণয়নে শ্রীভাসটাভা ব্রাউন ইউনিভার্সিটির দু জন স্নাতকের ছাত্র জাখারি লাজোয়ি এবং থমাস আসারউডের সাথে কাজ করেন। তাঁরা একটি এসআইআর মডেল পরিবর্তন করেন এবং টিকাদানের প্রভাব এবং আচরনের দুটি প্যারামিটার অন্তর্ভুক্ত করেন। এগুলোর মধ্যে সংক্রমনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রথমটি “সতর্কতার মাত্রা” নিয়ে যেটি নিরাপদ আচরন করার প্রতি মানুষের প্রবনতাকে অনুমান করে যেগুলোর মধ্যে রয়েছে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক পড়া এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এছাড়া এই প্যারামিটারটি নিরাপদ আচরন বৃদ্ধিতে ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমন হার, কোয়ারেন্টাইন, স্থাপনা বন্ধ করে দেয়া ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি সরকারের পদক্ষেপের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। দ্বিতীয় প্যারামিটারটি “নিরাপত্তাবোধ” নিয়ে যেটি অধিক মানুষ টিকা গ্রহন করার ফলে অতিমারি পূর্ববর্তী কর্মকাণ্ড আরম্ভ করতে মানুষের আত্মবিশ্বাসের প্রতি লক্ষ্য রাখবে।

টিকাদানের ঊর্ধ্বগতির কারনে যারা টিকা নেননি তাঁরা নিজেদের কিছুটা হলেও নিরাপদ বোধ করেছেন। এর কারনে টিকা প্রক্রিয়া আরম্ভের সময় সংক্রমনের সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পায় (সৌজন্যঃ ব্রাউন ইউনিভারসিটি)।
যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমনের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে আমাদের দল এরপর অপটিমাইজেশন আলগরিদম প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন প্যরামিটারের মান নির্ধারণ করে। এরপর আমাদের দল দেখতে পায় মডেলটি অতিমারির পুরো সময় জুড়ে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে এবং পৃথকভাবে রাষ্ট্র ও শহরগুলোতে সঠিকভাবে সংক্রমনের হার নির্ধারণ করেছে।
লাজোয়ী বলেন “উদাহরন হিসেবে বলা যায় আমরা যখন নিউইয়র্ক শহরকে বিবেচনা করেছিলাম আমরা সতর্ক ব্যবস্থায় ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করি ঠিক তখনই যখন মার্চের শেষভাগে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করে। এরপর সংক্রমনের সংখ্যা কমতে আরম্ভ করলে আমরা সতর্কতার মাত্রা কমতে দেখি এবং ছুটির সময় সংক্রমন আবারো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যায়”।
মডেলটিতে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করলে এটি পূর্বাভাস দিবে ভবিষ্যতে অতিমারির অবস্থা কেমন হতে পারে। যেমনঃ আমাদের দল বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে টিকা গ্রহনের হার কিভাবে সংক্রমনের হারকে প্রভাবিত করতে পারে। টিকাদানের ঊর্ধ্বগতির ফলে সংক্রমনের সংখ্যা কমে যেতে পারে কিন্তু এতে করে মানুষের সতর্কতার মাত্রাও কমে যেতে পারে এবং টিকা যারা গ্রহন করেননি তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ বাড়িয়ে দিতে পারে। এর ফলে টিকার জন্য সংক্রমনের হার কমা সত্ত্বেও সংক্রমনের হারের উপর ঊর্ধ্বমুখী চাপ পড়তে পারে। এক কথায় এই মডেলটি পরিস্থিতি অনুমান করতে পারে যেখানে টিকাদান আরম্ভের পর সংক্রমনের হার সল্প সময়ের জন্য ঊর্ধ্বমুখী হয় এবং পরবর্তীতে নিম্নমুখী হয়ে যায়।
যেমন যুক্তরাষ্ট্রে মডেলটি এপ্রিলের মাঝামাঝি অল্প সময়ের জন্য সংক্রমনের ঊর্ধ্বগতি শনাক্ত করে এবং এরপর সংক্রমণের হার আবার কমতে আরম্ভ করে। মডেলের পূর্বাভাস অনুযায়ী ভারতের মত অন্যান্য স্থানে সংক্রমনের ঊর্ধ্বগতির সাথে টিকা পরবর্তী সংক্রমন বৃদ্ধির মিল পাওয়া যায়। বর্তমান টিকাদানের হার অনুযায়ী মডেলটি পূর্বাভাস করে আগস্ট ২০২১ এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমনের সংখ্যা শূন্যের কোটার দিকে চলে যাবে।
গবেষকরা বলেন এ ধরনের অন্তর্দৃষ্টি সে সকল স্থানের জন্য কার্যকর যেখানে টিকাদান কর্মসূচী আরম্ভ হয়েছে।
লাজোয়ী বলেন “আমরা যুক্তরাষ্ট্র কে মাথায় রেখে মডেলটি প্রস্তুত করেছিলাম কিন্তু এটি অন্যান্য যেসব স্থানে সংক্রমনের হার এখনও অনেক বেশী যেমনঃ ভারত,ইউরোপ অথবা দক্ষিন আমেরিকায় পূর্বাভাস দেয়ার জন্য কাজে আসবে”।
এই মডেলিং এপ্রোচটি ভবিষ্যতে মহামারি অথবা অতিমারীর সময়ে ব্যবহার করা যাবে।
আসারউড বলেন “এই মডেলে এমন কিছুই নেই যে কারনে এটি কোভিড-১৯’র মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। আমরা মনে করি এই মডেলটি যে কোন সংক্রামন ব্যাধির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা সম্ভব যেখানে মানুষের আচরন গুরুত্বপূর্ণ।
